২৯ মাসের ব্যবধানে শীতল পানীয় জল প্রকল্পের কাজের দু’বার দুই ভিন্ন খাতে টেন্ডার – দু’বার উদ্বোধন- এও সম্ভব ?
২৯ মাসের ব্যবধানে দু’বার উদ্বোধন হল একই ’শীতল পানীয় জল প্রকল্পের’।প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া ব্যানার ঝুলিয়ে ঘটা করে হয় উদ্বোধন।আর দ্বিতীয়বার একেবারে চুপিসারে শুধুমাত্র প্রকল্প কাজের দেওয়ালের ফলকে লেখা থাকা অর্থ প্রাপ্তির তথ্য ও উদ্বোধনের তারিখ মুছে দিয়েই হয়ে যায় উদ্বোধন।
প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় বর্ধমান ১৪ এপ্রিল: – ২৯ মাসের ব্যবধানে দু’বার উদ্বোধন হল একই ’শীতল পানীয় জল প্রকল্পের’।প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া ব্যানার ঝুলিয়ে ঘটা করে হয় উদ্বোধন।আর দ্বিতীয়বার একেবারে চুপিসারে শুধুমাত্র প্রকল্প কাজের দেওয়ালের ফলকে লেখা থাকা অর্থ প্রাপ্তির তথ্য ও উদ্বোধনের তারিখ মুছে দিয়েই হয়ে যায় উদ্বোধন।পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর ১ পঞ্চায়েতের এই কীর্তি প্রকাশ্যে আসতেই প্রকল্পের কাজে নিয়ে উঠেছে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ। আর তা নিয়ে স্বোচ্চার হয়েছে বিরোধীরাও।
প্রচণ্ড গরমে পথ চলতি মানুষজন যাতে পথের ধারেই শীতল পানীয় জল পান সেই বিষষে উদ্যোগী হয় জামালপুর ১ পঞ্চায়েত। এই কাজের জন্য তারা স্থানীয় হাড়ালা এলাকার বিপদতারিণী মন্দির সংলগ্ন জায়গা বেছে নেন।মন্দিরটি মেমারি- তারকেশ্বর সড়ক পথের ধার রয়েছে।এই মন্দিরে প্রতিদিন প্রচুর ভক্ত ও পুণ্যার্থী যেমন পুজো দিতে আসেন তেমনই দেবী মাকে প্রণাম জানানোর জন্য যানবাহনের চালকরাও সেখানে গাড়ি দাঁড় করান।২০১৯ সালে শুরু হয় বিপদতারিণী মন্দিরের সামনে শীতল পানীয় জল প্রকল্প গড়ে তোলার কাজ ।প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পর ওই বছরেরই ২২ অক্টোবর জাঁকজমক পূর্ণ ভাবে প্রকল্পের উদ্বোধন হয়।
ওই দিন ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয় শীতল পানীয় জল প্রকল্পটি ।এছাড়াও ওই জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া একটি ব্যানারও ঝোলানো হয় । তাতে প্রকল্পের বিষয়ে সব তথ্য উল্লেখ করা থাকে ।জামালপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মেহেমুদ খাঁন ওই দিন শীতল পানীয় জল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। ব্লকের বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার,পঞ্চায়েত প্রধান ডলি নন্দী ও উপ-প্রধান সাহাবুদ্দিন মণ্ডল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন ।শীতল পানীয় জল প্রকল্পের দেওয়ালে যে ফলক লাগানো হয়েছিল তাতেও উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের নামও বড়বড় অক্ষরে লেখা থাকে । এছাড়াও জনগনের জ্ঞাতার্থে ওই প্রকল্পের দেওয়ালে লেখা থাকে ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে পঞ্চায়েত তার নিজস্ব তহবিল হইতে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে এই শীতল পানীয় জল প্রকল্প গড়ে তুলেছে।
বিপদতারিণী তলার শীতল পানীয় জল প্রকল্প নিয়ে এর পর থেকে কারুর মাথা ব্যাথার কোন কারণ থাকেনি।কিন্তু প্রায় তিন বছর বাদ চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে হড়ালা এলাকায় শোরগোল ফেলে দেয় ওই শীতল পানীয় জল প্রকল্প।শোরগোল পড়ার কারণটাও যথেষ্ট চাঞ্চল্যকর।হালাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন ,২০১৯ সালে প্রকল্পের উদ্বোধনের সময়ে তার দেওয়ালে ও ফলকে লেখা ছিল পঞ্চায়েতের ’নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে’ এই প্রকল্পটি গড়ে তুলেছে।তখন প্রকল্পের উদ্বেধনের তারিখ লেখা ছিল ’২২-১০-২০১৯’। কিন্তু সম্প্রতি ওই ফলেকে লেখা থাকা নানা তথ্য রাতারাতি বদলে দেওয়া হয়।এখন ফলকে দেখা যাচ্ছে ’পঞ্চায়েত ’নিজস্ব তহবিলের অর্থে’ এই বাক্যটি আর ফলকে লেখা নেই । পরিবর্তে সেখানে লিখে দেওয়া হয়েছে ’১৫ তম সেন্ট্রাল ফিনান্স কমিশনের (সি এফ সি ) অর্থে’ প্রকল্পটি গড়ে তোলা হয়েছে । এছাড়াও প্রকল্পের উদ্বোধনের তারিখ ’২২-১০-২০১৯’ মুছে দিয়ে সেখানে ’২২-০৩-২০২২’ লিখে দেওয়া হয়েছে।
এইসব দেখে হাড়ালাবাসী অভিযোগ করেছেন ,“ফলকে লেখা থাকা তথ্য এই ভাবে চুপাসাড়ে বদলে দেওয়া থেকেই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে এই প্রকল্প নিয়ে চুড়ান্ত ’আর্থিক অনিয়ম’ হয়েছে।বাসিন্দারা আরও জানান,তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন এই একই প্রকল্পের জন্য চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চায়েত নতুন করে ওয়ার্ক অর্ডার পাশ করায়। আর ওই ওয়ার্ক অর্ডার পাশ করিয়েই ’১৫ তম সেন্ট্রাল ফিনান্স কমিশনের’ তহবিল থেকে ৩ লক্ষ ৪৯ হাজার ৯৩০ টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে।সেটা আড়াল করতেই ফলকে লেখা থাকা ফলকে লেখা থাকা অর্থ প্রাপ্তির তথ্য ও উদ্বোধনের তারিখ বদলে দেওয়া হয়েছে ।
এই প্রসঙ্গে জামালপুর ১ পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান তথা জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি সহাবুদ্দিন মণ্ডল যে যুক্তি খাড়া করছেন তা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। তিনি জানিয়েছেন,বিপদতারিনী তলায় শীতল পানীয় জল প্রকল্প পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিলের অর্থে তৈরি করবে বলে ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত হয়। সেই মত পঞ্চায়েত প্রকল্পের কাজের টেন্ডারও করে। কাজটির বরাত পাওয়া ঠিকাদার সংস্থা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ করে দেয়।এরপর এলাকায় জনসংযোগ করার জন্য তাঁরা ওই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে দেন।তার পরেই করোনা অতিমারির প্রভাব বাড়ায় পঞ্চায়েতের অর্থ ঘাটতি তৈরি হলে ঠিকাদার সংস্থাকে তার প্রাপ্য টাকা পঞ্চায়েত মেটাতে পারেন না। একই কারণে পরের আর্থিক বছরেও ঠিকাদার সংস্থাকে টাকা দিতে পারা যায় না ।তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ফাণ্ড পরিবর্তন করে ১৫ তম ফিনান্সে প্রকল্পটিকে ধরিয়ে তার থেকে পাওয়া অর্থ ঠিকাদার সংস্থাকে মেটানো হবে।উপ-প্রধান জানান,সেই অনুযায়ী প্রকল্পের কাজের আগের টেন্ডার বাতিল করে দিয়ে ১৫ তম সি এফ সি প্রকল্পে কাজটি ঢোকানো হয়।এরপর নতুন করে টেন্ডার করা হয় ।আর যেহেতে ১৫ তম সি এফ সি থেকে ওই শীতল পানীয় জল প্রকল্পের কাজের অর্থ মিলেছে তাই আইনগত কারণে ফলকের লেখাও বদলাতে হয়েছে। উদ্বোধনের সময়ে ফলকে ’পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল অর্থে প্রকল্পটি তৈরি হয়েছে’ বলে যা লেখা ছিল সেটি মুছে দিয়ে ’১৫ তম সি এফ সি তহবিল অর্থে’ বলে লিখতে হয়েছে “। ফলকে প্রকল্পের উদ্বোধনের তারিখ বদলে দেওয়ার কারণ প্রসঙ্গে উপ-প্রধান সাফাই দেন ,“যিনি ফলকে ’১৫ তম সিএফসি তহবিল অর্থে’ কথাটা লিখতে গিয়ে ছিলেন তিনি ভুল বসত ফলকে লেখা থাকা উদ্বোধনের তারিখটাও বদলে দিয়ে ২২-০৩-২০২২ লিখে দিয়েছেন “ ।
উপ-প্রধানের এই যুক্তি অবশ্য মানতে চাননি জামালপুরের বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব।ব্লকের বিজেপি নেতা জীতেন্দ্রনাথ ডকাল বলেন, দুর্নীতি ধরা পড়ে যাওয়ায় এখন করোনার গল্প ফেঁদেছেন উপ-প্রধান। একই সঙ্গে তিনি বলেন ,“২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়ে তার উদ্বোধন হয়ে গেল। এর থেকেই পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে ওই প্রকল্পের কাজের টেন্ডার উদ্বোধনের আরও অনেক আগে করছে পঞ্চায়েত । তখন কোথায় করোনা !আসলে একই প্রকল্প কাজের জন্য বিভিন্ন সরকারী তহবিল থেকে অর্থ লুটে নিতেই তৃণমূল পরিচালিত জামালপুর ১ পঞ্চায়েত এইসব কাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জীতেনবাবু দাবী করেছেন।একই সঙ্গে তিনি বলেন, ওইসব করতে গিয়ে ফেঁসে যাওয়ায় উপ- প্রধান প্রকল্প কাজের উদ্বোধনের ফলকে লেখা থাকা তথ্য মুছে দিয়ে নতুন তথ্য লেখা করিয়েছেন। পঞ্চায়েতের নির্দেশের বাইরে লেখক ভুল করে কিছু লিখেছে এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না বলে জীতেনবাবু মন্তব্য করেছেন“। জামালপুরের সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য ,একই প্রকল্পের কাজ নিয়ে তিন বছরের ব্যবধানে দু’বার হওয়া টেন্ডারে অর্থের ফারাক-ই বলে দিচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
জেলাপরিষদের সহকারী সভাধীপতি দেবু টুডু সব শুনে বলেন ,“একটি প্রকল্পের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়ে যাবার পর আইন মাফিক ওই প্রকল্পের কাজের জন্য ফের নতুন করে আর টেন্ডার করা যায় না।প্রকৃত কি ঘটনা ঘটেছে তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে“ । বিডিও শুভঙ্কর মজুমদার বলেন ,’২০১৯ সালে বিপদতারিণী তলায় শীতল পানীয় জল প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমিও উপস্থিত ছিলাম ।তখন প্রকল্পের কাজটি যদি পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিল অর্থে হয়ে থাকে তাহলে এখন কেন অভিযোগ উঠছে প্রকল্পের কাজটি ১৫ তম ফিনান্স তহবিলের অর্থে হয়েছে তা বুঝে উঠতে পারছি না ।এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে বিডিও জানিয়েছেন’।