৫ টি জাতীয় পুরস্কার ও ১২ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারএ ভূষিত
১৯৬৩র এক ডিসেম্বরের ভোর, আনুমানিক ভোর ৫ টা | বিশপ লেফ্রয় রোডের এক বাড়ির সামনে একটি অস্টিন গাড়ি এসে দাঁড়ালো | আগাগোড়া শাল দিয়ে মোড়া এক লোক নেমে একটি বাড়িতে বেল বাজালেন, একবার নয় তিন চারবার – যদি গৃহকর্তার ঘুম না ভাঙে | কিছক্ষন পরে এক চাকর দরজা খুললো |
“আপনার বাবু ঘুম থেকে উঠেছেন ?” জনৈক আগুন্তুক প্রশ্ন করলেন |
“আজ্ঞে না, এখনো ওঠেননি, অন্যদিন উঠে যান, কাল একটু রাত পর্যন্ত কাজ করেছেন তো তাই এখনো ওঠেননি |”
“ওনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই, যদি দয়া করে একটু ডেকে দেন |”
“এপয়েন্টমেন্ট করা ছিল ?”
“না, খুব জরুরি দরকার, তাই এতো ভোর ভোর ঘুম ভাঙিয়ে ……”
“আসলে এপয়েন্টমেন্ট না হলে বাবু তো দেখা করতে পারেন না….”
“আমি জানি, তাই এতো ভোরে এসেছি , খুব, খুব দরকার |”
“আচ্ছা, বসুন | কি নাম বলবো ?”
“বলবেন অরুনবাবু এসেছেন | অরুন কুমার চট্টোপাধ্যায় |”
মিনিট কুড়ি বাদে ঘরে এক দীর্ঘদেহী লোকের প্রবেশ …
“আরে উত্তমবাবু আপনি ? এতো ভোরে ? আমার কাছে ? সব ঠিক আছে তো ? কিছু বিপদ হলো ? ”
“আরে না মানিকবাবু, সেরকম কিছুই হয়নি, তবে কিছুটা সেরকম বলতেই পারেন |”
“একটু খুলে বলবেন, যদি কিছু করতে পারি |”
“আমি কেমন অভিনেতা মানিকবাবু ? আমার মধ্যে কি ত্রুটি আছে একটু বলবেন ?”
“কি বলছেন উত্তমবাবু, আপনার অভিনয়ের মধ্যে ত্রুটি ? আপনি সারা বাংলার নয়নের মণি…”
“না মানিকবাবু, আমি সারা বাংলার নয়, আপনার মতামত চাই | একেবারে সৎ উত্তর জানতে চাই, খোলাখুলি |”
“সত্যি কথা বলবো ?”
“একদম ! সেটাই তো চাই মানিকবাবু |”
“আমি মনে করি আপনার মতো অভিনেতা ভারতবর্ষ কেন, সারা পৃথিবীতে ১০০ বছরে একটা আসে | আপনার তিরোধানের পরে বাঙালি কমকরে ১০০ বছর আপনাকে মনে রাখবে, আপনাকে মিস করবে | আপনি অভিনেতা নন , কিংবদন্তি |”
“তবে আপনার মতো একজন বিশ্ববিরেন্য পরিচালক আমার পাশের পাড়াতে থাকা সত্ত্বেও আমি আপনার ছবিতে সুযোগ পাচ্ছি না কেন ?”
উত্তম কুমারের দিকে একদৃষ্টে মিনিটখানেক তাকিয়ে থাকলেন সত্যজিৎ রায় | তারপর বললেন, “সত্যি কথা আপনার কাছে স্বীকার করি ? আপনার মতো লোকের কাছে আমার অক্ষমতা স্বীকার করতে আমার বাধা নেই |”
“আপনার অক্ষমতা !!!”
“হ্যাঁ উত্তমবাবু, আপনার যা পারিশ্রমিক তার অর্ধেক আমার একটা ছবির পুরো প্রোডাকশন বাজেট | আপনাকে এফোর্ড করার ক্ষমতা আমার নেই |”
“ওহ এই কথা | আমি আপনার ছবিতে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি |”
“তা কি করে হয়, আমি একজন পরিচালক হয়ে জানি আপনার মূল্য কত উত্তমবাবু | আমি আপনাকেও বলতে চাই, আপনি যে পারিশ্রমিক নেন, সেটাও অনেক কম |”
“আপনি জানেন, স্টার হয়েও আপনার সাথে কাজ না করার যন্ত্রণা কী ? আমি রাতে ঘুমাতে পারি না মানিক বাবু; শ্রোতাদের করতালির মধ্যে আমি হাহাকার শুনি, স্তাবকদের মাঝে আমি দিশাহারা | I am surrounded by ‘yes’ men !!!”
“আপনি এরকম একদম ভাববেন না উত্তমবাবু | আপনার অভিনয় নিয়ে কারুর কিছু বলার নেই, আমারও নেই | তবে আপনি যখন এলেন, আমি আপনাকে নিয়ে কোনো চিত্রনাট্য নিশ্চই ভাববো | যেটা আপনি ছাড়া কাউকে মানাবে না, কেউ করতে পারবে না | আমাকে একটু সময় দিন |”
“আপনি আমায় বাঁচালেন ! কী বলে যে ধন্যবাদ দেব আপনাকে !!! আমি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি যাচ্ছি আজ মানিকবাবু !!! এক অবর্ণনীয় যন্ত্রনা থেকে আজ মুক্তি পেলাম !!! অশেষ অশেষ অজস্র ধন্যবাদ !!!”
“আরে চললেন কোথায়? চা খেয়ে যাবেন, আপনার মতো মানুষ প্রথম বার এসে এরকম ভাবে চলে যাচ্ছেন… ”
“চা-টা তোলা থাক, আপনার চিত্রনাট্য শুনতে শুনতে খাবো | যবে ডাকবেন |”
“নিশ্চই, আমাদের দেখা হবে | নমস্কার !”
_এই ঘটনার দুই বছর পর ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত উত্তম কুমার অভিনীত বাংলা ছায়াছবি ” নায়ক ” | ৫ টি জাতীয় পুরস্কার ও ১২ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারএ ভূষিত এক কালজয়ী বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমা !!!