করোনা ভ্যাকসিনের কুপন পাওয়ার জন্য ইঁট পেতে লাইন

রাত তখন ৮টা। কালনা শহরের পুরনো বাসস্ট্যান্ডের পুরসভার উত্তরণ ভবনের বন্ধ লোহার গেটের সামনে বসে ভাত-তরকারি খাচ্ছিলেন পূর্বস্থলীর নোনারমাঠ এলাকার বাসিন্দা রঞ্জিত বসাক। বছর পঁয়ত্রিশের তাঁতশিল্পী বলেন, ”করোনার টিকার কুপন জোগাড়ের জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরছি। আগে এক দিন রাত ১টা নাগাদ ইট পেতে লাইন দিয়েও কুপন পাইনি।শুনলাম, মঙ্গলবার সকালে টিকার কুপন দেওয়া হবে পুরসভার এই ঘর থেকেই। সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়, সে জন্য বিকেল ৫টাতেই ইট পেতে লাইন দিয়েছি।” সারা রাত এখানেই কাটবে, তাই বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে নিচ্ছেন, জানালেন তিনি।

ওই ভবনের সামনে ঝুলছে পুরসভার নোটিস। তাতে জানানো হয়েছে, মঙ্গল ও বুধবার ৩০০টি করে কুপন দেওয়া হবে। তবে কুপন পাওয়ার আশায় রাত ৮টাতেই দেখা গেল অন্তত হাজারখানেক ইট, বোতল, মাটির ভাঁড় রেখে লাইন দেওয়ার ছবি। ইটের গায়ে নামও লিখে রেখেছেন অনেকে। কেউ কেউ বোতলে ঝুলিয়ে রেখেছেন টিকার কুপন নিতে চাওয়া ব্যক্তিদের নাম। নিজের পাতা ইট কোন জায়গায় রাখা হচ্ছে, অনেকে মোবাইলে সে ছবিও তুলে রাখছেনন। কালনা শহরে টিকার কুপন দেওয়া হলেও, যাঁরা লাইন দিয়েছেন তাঁদের বেশিরভাগই এসেছেন সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, পূর্ব সাতগাছিয়া, এমনকি, লাগোয়া জেলা নদিয়ার শান্তিপুর থেকেও।

ওই বাসিন্দারা জানান, বাড়ির লোকজনের জন্য লাইনে ইট রেখে আশপাশে ঘোরাফেরা করছেন তাঁরা। গভীর রাত থেকে টোটো, মোটরভ্যান-সহ নানা যানবাহনে এসে পৌঁছচ্ছেন পরিজনেরা। যত জন কুপন পাবেন, সকাল ৬টায় লাইনে তত জনের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে স্লিপ। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ওই স্লিপ দেখে টিকার কুপন দিচ্ছেন পুরসভার কর্মীরা। সে কুপন নিয়ে কালনা মহকুমা হাসপাতালে গিয়ে ফের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিতে হচ্ছে।

মঙ্গলবার টিকার টোকেন দেওয়া শেষ হতে না হতেই, বুধবারের কুপন পাওয়ার জন্য ভিড় জমতে শুরু করে পুরনো বাসস্ট্যান্ড চত্বরে। দুপুর ১২টা বাজতে না বাজতেই ইটের সারি লম্বা হতে থাকে। কেউ রান্না করা খাবার, কেউ আবার শুকনো খাবার নিয়ে জড়ো হন। পূর্ব সাতগাছিয়ার মালপাড়ার বাসিন্দা স্বপ্না বিশ্বাস, একাদশী বিশ্বাসেরা বলেন, ”কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে প্রথম ডোজ়ের টিকা মিলছে না। তাই বাধ্য হয়ে রাত জেগে লাইন দিতে হচ্ছে। এর আগে, দু’দিন রাত ১টায় লাইন দিয়েও কুপন না মেলায়, এ দিন দুপুর ১টাতেই পৌঁছে গিয়েছি।”

পুরসভা এলাকার টিকার কুপন গ্রামীণ এলাকার লোকজন এসে লাইন দিয়ে নিয়ে নেওয়ায় ক্ষুব্ধ শহরবাসীর একাংশ। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ”শহরে টিকাকরণ বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। তবে কালনা শহরে এখন যা পরিস্থিতি, তাতে শহরের কত মানুষ টিকা পাচ্ছেন, বোঝা যাচ্ছে না।” কালনা মহকুমা হাসপাতালের সহকারী সুপার গৌতম বিশ্বাস বলেন, ”করোনার টিকার চাহিদা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে দৈনিক যাতে এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে দেড় হাজার টিকা দেওয়া যায়, সে আর্জি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।” কালনা পুরসভার প্রশাসক আনন্দ দত্ত বলেন, ”গ্রামের মানুষজন লম্বা লাইন দিয়ে টিকা নিচ্ছেন। শহরবাসীর জন্য কী পদ্ধতিতে টিকাকরণ আরও সহজ করা যায়, তা নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *