দাবা সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন

দাবা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রাচীন খেলা যা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ খেলে থাকে। এটি শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, এটি মস্তিষ্কের জন্য একটি চমৎকার ব্যায়াম।
দাবা খেলার উপকারিতা
দাবা খেলার অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে, যা মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়তা করে:
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি: দাবা খেলা মস্তিষ্কের উভয় গোলার্ধকে সক্রিয় রাখে। এটি আপনার সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি: দাবা খেলার সময় আপনাকে বিভিন্ন চাল, কৌশল এবং প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য পদক্ষেপ মনে রাখতে হয়। এটি আপনার স্মৃতিশক্তি এবং পুনরুদ্ধার ক্ষমতা উন্নত করে।
- একাগ্রতা ও মনোযোগ বৃদ্ধি: দাবা খেলতে প্রয়োজন গভীর মনোযোগ। খেলার সময় আপনাকে প্রতিটি চালের ওপর সম্পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করতে হয়, যা আপনার একাগ্রতা এবং মনোযোগ বাড়াতে সহায়ক।
- সৃজনশীলতা বৃদ্ধি: দাবা খেলা আপনাকে নতুন এবং উদ্ভাবনী কৌশল চিন্তা করতে উৎসাহিত করে, যা আপনার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে।
- চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি: দাবা খেলার সময় খেলোয়াড়দের বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যার ফলে চাপ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তৈরি হয়।
- পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা: দাবা আপনাকে প্রতিটি চালের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে চিন্তা করতে শেখায়। এটি আপনার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং দূরদর্শিতা বাড়ায়।
- ধৈর্য ও সহনশীলতা: দাবা একটি ধীর গতির খেলা, যেখানে প্রতিটি চালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এটি আপনাকে ধৈর্য এবং সহনশীলতা শেখায়।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: দাবা খেলায় জয়লাভ আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং হেরে গেলে পরাজয় মেনে নিতে শেখায়।
- সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি: যদিও দাবা একটি একক খেলা, তবে টুর্নামেন্ট বা ক্লাবে খেলার মাধ্যমে নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া যায়, যা সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
দাবা খেলার ইতিহাস
দাবা খেলার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতে, প্রায় ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তখন এর নাম ছিল ‘চতুরঙ্গ’। এই খেলাটি চারটি বিভাগ নিয়ে গঠিত ছিল – পদাতিক (সৈন্য), অশ্বারোহী (ঘোড়া), হস্তী (হাতি) এবং রথ (নৌকা)। ভারত থেকে এই খেলাটি পারস্যে (বর্তমান ইরান) ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে এটি ‘শতরঞ্জ’ নামে পরিচিত হয়। এরপর পারস্য থেকে এটি আরব বিশ্বের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইউরোপে এসে এর নাম হয় ‘চেস’। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপে দাবার গুটির চাল পরিবর্তন করা হয় এবং আধুনিক দাবার রূপ লাভ করে। আধুনিক দাবার জনক হিসেবে উইলহেম স্টেইনিজকে (Wilhelm Steinitz) ধরা হয়।
দাবা খেলার নিয়মকানুন
দাবা একটি ৬৪টি বর্গক্ষেত্রের একটি বোর্ডের ওপর খেলা হয়। প্রতিটি খেলোয়াড়ের ১৬টি করে গুটি থাকে – একটি রাজা, একটি মন্ত্রী, দুটি নৌকা, দুটি ঘোড়া, দুটি হাতি এবং আটটি সৈন্য।
বোর্ড সাজানো - বোর্ডের ডানদিকের নিচের কোণার ঘরটি সবসময় সাদা হয়।
- প্রতিটি খেলোয়াড়ের প্রথম সারিতে নৌকা, ঘোড়া, হাতি, মন্ত্রী ও রাজা বসে। দ্বিতীয় সারিতে ৮টি সৈন্য থাকে।
- সাদা মন্ত্রী সাদা ঘরে এবং কালো মন্ত্রী কালো ঘরে বসে।
গুটির চাল
প্রতিটি গুটির চাল ভিন্ন: - রাজা (King): যেকোনো দিকে এক ঘর করে চলতে পারে।
- মন্ত্রী (Queen): বোর্ডের যেকোনো দিকে, যেকোনো সংখ্যক ঘর চলতে পারে (সোজাসুজি, কোনাকুনি)।
- নৌকা (Rook): সোজাসুজি (উল্লম্ব বা অনুভূমিক) যেকোনো সংখ্যক ঘর চলতে পারে।
- হাতি (Bishop): কোনাকুনি যেকোনো সংখ্যক ঘর চলতে পারে।
- ঘোড়া (Knight): ‘L’ আকৃতিতে চলে (আড়াই ঘর)। এটি একমাত্র গুটি যা অন্য গুটির ওপর দিয়ে লাফিয়ে যেতে পারে।
- সৈন্য (Pawn): প্রথম চালে এক বা দুই ঘর সোজা যেতে পারে। এরপর শুধু এক ঘর সোজা যেতে পারে। সৈন্য শুধুমাত্র কোনাকুনি এক ঘর এগিয়ে প্রতিপক্ষের গুটি খেতে পারে। এটি পিছন দিকে চলতে বা খেতে পারে না।
জয় ও পরাজয়
দাবা খেলার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের রাজাকে ‘চেকমেট’ করা। যখন প্রতিপক্ষের রাজা এমন অবস্থায় পড়ে যে তাকে কোনোভাবেই আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায় না, তখন তাকে চেকমেট বলা হয় এবং খেলা শেষ হয়।
দাবা খেলার কৌশল
দাবায় ভালো করতে হলে কিছু মৌলিক কৌশল জানা জরুরি: - কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ: বোর্ডের মাঝের ঘরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি আপনাকে গুটি চলাচলের স্বাধীনতা দেয় এবং প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে।
- গুটিগুলির বিকাশ: দ্রুত আপনার সমস্ত গুটিগুলিকে বোর্ডের মধ্যে নিয়ে আসুন এবং সক্রিয় করুন।
- রাজার নিরাপত্তা: আপনার রাজাকে সুরক্ষিত রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাসলিং করে রাজাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া একটি ভালো কৌশল।
- কৌশলী আক্রমণ: প্রতিপক্ষের দুর্বলতা চিহ্নিত করে পরিকল্পিত আক্রমণ চালান।
- ফাঁদ পাতা (Traps): প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেলে তাদের গুটি খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
- শেষের খেলা (Endgame): দাবার শেষ ভাগে সৈন্য এবং রাজার কৌশল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দাবা একটি অসাধারণ খেলা যা আপনার মস্তিষ্ককে শাণিত করে এবং জীবনযাপনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই খেলাটি আপনাকে শেখাবে কীভাবে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে হয় এবং প্রতিটি পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়।