সরকারি সাহায্যের আশায় কাতর আর্তি তাঁত শিল্পীদের

বাঁকুড়া:- ঠক্ ঠক্ আওয়াজে ঘুম ভাঙতো গঞ্জবাসীর। শিল্পী তৈরি করা গামছা কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে রপ্তানি হতো ভিন রাজ্য অন্য দেশে বিভিন্ন যানবাহনে করে। কাঁচামাল আমদানি হতো লরি ভর্তি করে। চাহিদার চাপে পড়ে নাওয়া খাওয়ার সময় জুটতো না। দিন রাত জেগে কাজ করতে বরাত তুলে দিতে হতো ব্যবসায়ীর হাতে। এখন সে সব অতীত! বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি তাঁত চলছে নমো নমো করে। কোনরকমে গুজরান করছেন শিল্পীরা। সরকারি সাহায্যের আশায় কাতর আর্তি শিল্পী এবং শিল্পীদের পরিবারের।

আমরা কথা বলছি, বাঁকুড়ার রাজগ্রামের যেখানে সারি সারি তাঁত বুনোন মেশিন দিয়ে তৈরি হতো গামছা তাঁতে শাড়ি ।এমনিতেই কাঁচামালের চড়া দাম, পুঁজির অভাব, চাহিদার কমতি, সবে মিলে এখন প্রায় ধুঁকছে কুটির শিল্পের প্রাচীন এই জনপদ রাজগ্রাম। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। একটা সময় ছিল যখন রাজগ্রামের এই গাছমার চাহিদা ছিল বাজারে অপরিসীম।রাজগ্রাম জুড়ে ছিল ৩০০ টি ছোট বড় গামছা তৈরীর কারখানা ছিল। বন্ধ হতে হতে এখন তা ৫০ টি ঠেকেছে। তাও প্রতিদিন কাজ হয় না। যারা একটু পুঁজিপতি, ব্যবসা বাণিজ্য চালু আছে তারাই সপ্তাহে দু তিন দিন কাজ করে কারখানা খোলে। অন্যদের সকালবেলা কারখানা খুলে ঠাকুরকে ধুপ দেখানো, বন্ধ করা এই যেন রোজনামচা হয়ে গেছে।রাজগ্রামে এই হস্ত শিল্পীদের তৈরি গামছার চাহিদা দিন দিন কমে আসছে এই সুপারসোনিজ মেসিনারির যুগে।

একটা সময় ছিল এই গামছা তৈরির উপর নির্ভর করেই রাজগ্রামের শিল্পীদের জীবন জীবিকা চলতো।এলাকার দু থেকে আড়াই হাজার মানুষ গামছা তৈরি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতো। এই শিল্পই তাদের ঘরসংসারের খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, স্বাদ আহ্লাদ, পূজা পার্বণ, আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছে। কিন্তু করোণা অতিমারিতে জের এবং আধুনিক মেসিবারির যুগে এখন প্রায় ধুকতে বসেছে আদি অনন্তকাল ধরে বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই কুটির শিল্প। ধুকছে গ্রাম বাংলার প্রাচীন এই জনপদও।

কারন শুধু লকডাউন তেমটা নয়। এক দশক আগেও এই গামছার বহুল ব্যবহার ছিল জেলা এবং জেলার সীমানা পেরিয়ে রাজ্য এবং বিদেশের বাজারেও। বাড়িতে দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যবহার হতো এই গামছা। বাড়িতে আত্মীয় কুটুম্ব জামাই জন এলে তাদের একখানা নতুন গামছা বের করে দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল গ্রামবাংলায়। কিন্তু সেইসব আজ অতীত। বর্তমানে এই হাতে বোনা গামছার জায়গা নিয়ে নিয়েছে আধুনিক মেসিনারিতে তৈরি গামছা,তোয়ালে সহ আরো অনেক আধুনিক জিনিস। আজ এই গামছার কদর কমেছে।এই গামছা কাজে লাগে শুধুমাত্র ঠাকুর পুজোর কাজে কিমবা বাড়ির মেয়েদের বিয়েতে কিয়েক ডজন যৌতুক হিসাবে বরপক্ষকে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছ জেলার অনেকাংশেই। কিন্তু করোণা অতিমারির প্রভাবে কার্যত লকডাউনের জেরে নমো নমো করে হচ্ছে বিয়েবাড়ি, উপন্নয়ন, অন্নপ্রাশন্ন সহ সামাজিক অনুষ্ঠান। তাই এই গামছার চাহিদা নেই বললেই চলে। তার উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো কার্যত লকডাউন এর জেরে সকাল দশটার পর বন্ধ দোকানপাট, বন্ধ বাজারহাট, বন্ধ যানবাহন, এখন কিছুটা ছাড় মেললেও বাজারের মন্দা চলছেই। যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে গত দু’বছরে কাঁচামালের দ্বিগুণ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। শেষের মুখে বাঁকুড়ার ঐতিহ্যবাহী হাতে বুনো রাজগ্রামের গামছা শিল্প। এ প্রজন্মের কেউ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চায় না।প্রচন্ড কষ্ট, চাহিদা নেই, পুঁজির অভাব। অনেকেই লেখাপড়া শিখে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। অনেকেই আবার বাপ ঠাকুরদাদার সৃষ্ট এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছেন কিছু ভালো দিন ফেরার আশায়।যদি মেলে সরকারি সাহায্যে, রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের কাতর আর্তি জানিয়েছেন গামছা তৈরির সাথে যুক্ত শিল্পীরা। যদি সরকার সাহায্য করে তবে আবার স্বমহিমায় ফিরতে পারে গামছা তৈরীর কুটির শিল্প। বাঁচবে শিল্পী বাঁচবে শিল্প এমনটাই দাবি শিল্পীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *